স্বদেশ ডেস্ক:
বর্তমানে ডেঙ্গুজ্বরের প্রার্দুভাব প্রবল আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তাই আপনি সচেতন হোন। প্রতিবেশীকে সচেতন হতে উৎসাহ দিন।
ডেঙ্গু প্রাণঘাতী রোগ না হলেও কয়েক বছরে অনেক রোগী এ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় রোগটি এখন আতঙ্কই। তবে আশার কথা হলো, সঠিক চিকিৎসা ও নিয়ম মেনে চললে রোগটি থেকে পুরোপুরি মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আসুন, আমরা ডেঙ্গুজ্বরের ভয়াবহ রূপ ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ও এর প্রতিরোধের উপায় জেনে নিই এবং সচেতন হই।
ডেঙ্গু শক সিনড্রোম : ডেঙ্গুজ্বরের ভয়াবহ রূপ হলো ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের সঙ্গে সার্কুলেটরি ফেইলিউর হয়ে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হয়। এর লক্ষণ হলো রক্তচাপ হঠাৎ কমে যাওয়া, নাড়ির স্পন্দন অত্যন্ত ক্ষীণ ও দ্রুত হয়। শরীরের হাত-পা ও অন্যান্য অংশ ঠাণ্ডা হয়ে যায়। প্রস্রাব কমে যায়। হঠাৎ করে রোগী জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারে, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধের উপায় : ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধের মূলমন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ এবং এই মশা যেন কামড়াতে না পারে, এর ব্যবস্থা করা। মনে রাখতে হবে, এডিস একটি ভদ্র মশা। অভিজাত এলাকায় বড় বড় সুন্দর সুন্দর দালান-কোঠায় এগুলো বাস করে। স্বচ্ছ পরিষ্কার পানিতে এই মশা ডিম পাড়ে। ময়লা দুর্গন্ধযুক্ত ড্রেনের পানি এগুলোর পছন্দসই নয়। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার ডিম পাড়ার উপযোগী স্থানগুলো পরিষ্কার রাখতে হবে। একই সঙ্গে মশক নিধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, জঙ্গল, জলাশয় ইত্যাদি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। যেহেতু এডিস মশা মূলত এমন বস্তুর মধ্যে ডিম পাড়ে- যেখানে স্বচ্ছ পানি জমে থাকে, সেহেতু ফুলদানি, অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলতে হবে। ব্যবহৃত জিনিস- মুখ খোলা পানির ট্যাংক, ফুলের টব ইত্যাদিতে যেন পানি জমে না থাকে, এ ব্যবস্থা করতে হবে।
ঘরের বাথরুমে কোথাও জমানো পানি ৫ দিনের বেশি যেন না থাকে। অ্যাকুরিয়াম, রেফ্রিজারেটর বা এয়ারকন্ডিশনারের নিচেও যেন পানি জমে না থাকে। এডিস মশা সাধারণত সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। তবে অন্য সময়ও কামড়াতে পারে। তাই দিনের বেলা শরীর ভালোভাবে কাপড়ে ঢেকে বের হতে হবে, প্রয়োজনে মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে। ঘরের চারদিকে দরজা-জানালায় নেট লাগাতে হবে।
দিনে ঘুমালে মশারি টাঙিয়ে অথবা কয়েল জ্বালিয়ে ঘুমাতে হবে। শিশুদের যারা স্কুলে যায়, তাদের হাফ প্যান্ট না পরিয়ে ফুল প্যান্ট বা পাজামা পরিয়ে স্কুলে পাঠাতে হবে। ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই সব সময় মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে রোগীকে কোনো মশা কামড়াতে না পারে। মশক নিধনের জন্য স্প্রে, কয়েল, ম্যাট ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্য দিনে ও রাতে মশারি ব্যবহার করতে হবে। ডেঙ্গুজ্বর হয়তো বা নির্মূল করা যাবে না। এর কোনো ভ্যাকসিন বের হয়নি, কোনো কার্যকর ওষুধও আবিষ্কৃত হয়নি। ডেঙ্গুজ্বরের মশাটি আমাদের দেশে আগেও ছিল, এখনো আছে এবং মশা প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির পরিবেশও আছে। তাই ডেঙ্গুজ্বর ভবিষ্যতেও থাকবে। একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
করণীয় ও চিকিৎসা : তীব্র ধরনের ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রকাশ পেলে বাসায় চিকিৎসা করার সুযোগ নেই। মনে রাখবেন, তীব্র ডেঙ্গু এক ধরনের মেডিক্যাল ইমার্জেন্সি। এসব রোগীকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা নিতে হবে। গড়ে প্রতি ২০ জনে একজন তীব্র ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হতে পারেন। তীব্র ডেঙ্গুতে রক্তচাপ কমে রোগী শকে চলে যেতে পারে। রোগীর অভ্যন্তরীণ অঙ্গ থেকে শুরু হতে পারে রক্তক্ষরণ। যাদের আগে একবার ডেঙ্গু হয়েছে, তাদের দ্বিতীয় আক্রমণে তীব্র ডেঙ্গু হতে পারে। এ সময় রক্তের অণুচক্রিকা কমে যেতে পারে খুব দ্রুত। এ জন্য প্রতিদিন রক্ত পরীক্ষা করে অণুচক্রিকার পরিমাণ জানতে হয়। এই সংখ্যা ৫০ হাজারের নিচে নেমে গেলে দিনে অন্তত দুইবার এ পরীক্ষা করা দরকার। একই সঙ্গে নজর রাখতে হবে ডেঙ্গুর ভয়ানক উপসর্গের দিকে।
ডেঙ্গুর কোনো নির্ধারিত চিকিৎসা নেই। প্রকাশিত লক্ষণের শুধু চিকিৎসা করতে হবে। এ জন্য কারও ডেঙ্গু হলে করণীয় হলো পূর্ণ বিশ্রাম নিন। শারীরিক ও মানসিক বিশ্রাম গ্রহণ করুন। পর্যাপ্ত পানি পান করুন। শরবত, ফলের রস, স্যুপ, ডাবের পানি, স্যালাইন পানি পান করুন। জ্বর বা ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল সেবন করুন। এসপিরিন, আইবোপ্রোফেন কিংবা ব্যথা-বেদনানাশক ট্যাবলেট গ্রহণ করবেন না। এগুলো ডেঙ্গু রক্তক্ষরণজনিত জটিলতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
ডেঙ্গুজ্বর চলে যাওয়ার ২৪ ঘণ্টা পর যদি শরীর বেশি খারাপ হতে থাকে, তা হলে অবশ্যই সতর্ক হোন। রক্ত পরীক্ষা করে অণুচক্রিকা ও হেমাটোক্রিটের পরিমাণ জেনে নিন। রক্তের অণুচক্রিকা কমতে থাকলে দ্রুত হাসপাতালে চলে আসুন। অণুচক্রিকা দশ হাজারের নিচে নেমে গেলে কিংবা রক্তক্ষরণ শুরু হলে রক্ত প্রদান করুন। রক্তের অণুচক্রিকা বৃদ্ধির জন্য পেঁপে, পেঁপে পাতার রস, দুধ, ডালিম ইত্যাদি খেতে হবে। পেঁপে পাতার রস অণুচক্রিকা বৃদ্ধির জন্য কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তবে ডেঙ্গু চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ উত্তম।
লেখক : জনস্বাস্থ্যবিষয়ক